প্রিয় শিক্ষার্থী, তোমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, আমরা ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণিতে আমাদের প্রিয়নবি মুহাম্মাদ (সা.) -এর জন্ম, নবুওয়াত, কাফির-মুশরিকদের অত্যাচার-নির্যাতন-প্রতিরোধ উপেক্ষা করে মক্কায় ইসলাম প্রচার, আল্লাহর দিদারে মি'রাজ গমন এবং মদিনায় হিজরত পর্যন্ত জীবনচরিত সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেছি। এ শ্রেণিতে তোমাদেরকে হিজরত পরবর্তী প্রিয়নবি (সা.)-এর ইসলাম প্রচার, মদিনা রাষ্ট্র গঠন, বদর, উহদ, খন্দক যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুদ্ধনীতি এবং হুদায়বিয়ার সন্ধি ও এর তাৎপর্যসহ আরো অনেক বিষয় সম্পর্কে জানবো।
মদিনায় হিজরত
৬২২ খ্রিস্টাব্দে মহানবি (সা.) জন্মভূমি মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু হযরত আবু বকর (রা.) হিজরতের সঙ্গী ছিলেন। মদিনায় যাত্রা পথে তাঁরা সাওর পর্বতের গুহায় আশ্রয় নেন। ঘটনাচক্রে কাফিরদের একটি দল সাওর পাহাড়ের নিকটে এসে উপস্থিত হয়। হযরত আবু বকর (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে বিচলিত হয়ে পড়েন। তখন নবি করিম (সা.) তাকে সান্তনা দিয়ে বলেন-
لَا تَحْزَنْ إِنَّ اللَّهَ مَعَنَا
অর্থ: তুমি চিন্তা করো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন। (সূরা আত-তওবা, আয়াত: ৪০)
পর্বতের গুহায় তাঁরা তিনদিন অবস্থান করেন। এ সময় হযরত আবু বকর (রা.)-এর কন্যা হযরত আসমা (রা.) তাঁদের জন্য গোপনে খাবার পৌঁছে দিতেন। এখানে ৩দিন অবস্থানের পর ৪র্থ দিনে তাঁরা লোহিত সাগরের অপরিচিত পথ ধরে ইয়াসরিবের দিকে যাত্রা করেন। ছয় দিনের অবিরাম যাত্রার পর ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ২২ সেপ্টেম্বর সোমবার তিনি ইয়াসরিবের কয়েক মাইল দূরে কুবা নামক স্থানে পৌঁছেন। এখানে চার দিন থাকার পর ২৭ সেপ্টেম্বর শুক্রবার মহানবি (সা.) মদিনায় (ইয়াসরিব) পৌঁছেন। ইসলামের ইতিহাসে মহানবি (সা.)- এর মক্কা থেকে মদিনায় গমনকেই হিজরত বলা হয়। মহানবি (সা.)-এর আগমনে খুশি হয়ে ইয়াসরিববাসী এর নতুন নাম রাখেন মদিনাতুন্নবি বা নবির শহর।
মদিনায় হিজরতের গুরুত্ব
মহানবি (সা.) -এর মদিনায় হিজরত একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা। এর ফলে ইসলামের জয়যাত্রা শুরু হয়। মুসলমানদের কষ্টের জীবনের অবসান ঘটে। ইসলামের অনুসারীর সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। আশেপাশের অঞ্চলে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে যায়। অল্প দিনের মধ্যেই মহানবি (সা.) মদিনার আউস, খাযরাজ, বনু নাযির, বনু কারনুকা ও তাদের বন্ধু গোত্রসমূহ নিয়ে একটি ইসলামি সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার গোড়াপত্তন করতে সক্ষম হন। সকল গোত্র ও সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ করে একটি জাতি গঠন করেন। ফলে মদিনাবাসী নিজেদের কলহ-বিবাদ ভুলে গিয়ে ভ্রাতৃত্ববোধে উদ্বুদ্ধ হয়। এভাবে মহানবি (সা.) সকল ধর্মের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করে একটি আদর্শ রাষ্ট্র গঠন করতে সক্ষম হন।
মদিনা সনদ
মদিনায় এসে মহানবি (সা.) একটি আদর্শ জাতি ও রাষ্ট্র গঠনে মনোনিবেশ করেন। প্রথমে তিনি আরবদের চিরাচরিত গোত্রীয় পার্থক্য তুলে দেন। আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে একতা ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সুদৃঢ় করেন। তিনি অন্যান্য ধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করেন এবং সকলকে ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান করেন। তিনি একটি কল্যাণকর সমৃদ্ধ জাতি গঠন ও সর্বধর্মীয় শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করার জন্য মদিনা ও আশেপাশের অঞ্চলসমূহের মুসলমান, ইহুদি ও পৌত্তলিকদের নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক সনদ স্বাক্ষর করেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এটা মদিনা সনদ (The Charter of Medinal নামে পরিচিত। এ সনদের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ধারা নিম্নরূপ:
মদিনা সনদ
১. বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম, এটা মহানবি মুহাম্মাদ (সা.)-এর পক্ষ থেকে লিখিত অঙ্গীকারনামা।
২. মদিনার পৌত্তলিক, ইহুদি এবং মুসলমান সবাই মিলে এক জাতি (উন্মাত)।
৩. মুসলিম, ইহুদি ও অন্যান্য সম্প্রদায় নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে, কেউ কারো ধর্মে হস্তক্ষেপ করবে না।
৪. চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী কোনো সম্প্রদায় বাইরের শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হলে মদিনার সকল সম্প্রদায় সম্মিলিতভাবে সে আক্রমণকে প্রতিহত করবে।
৫. দুর্বল ও অসহায়কে রক্ষা ও সাহায্য করতে হবে।
৬. এখন হতে মদিনায় রক্তপাত, হত্যা ও রাহাজানি নিষিদ্ধ করা হলো।
৭. স্বাক্ষরকারী কোনো সম্প্রদায়ের কোনো ব্যক্তি অপরাধ করলে তা ব্যক্তিগত অপরাধ হিসেবেই বিবেচিত হবে। সেজন্য অপরাধীর সম্প্রদায়কে দায়ী করা যাবে না।
৮. কেউ কুরাইশদের সাথে কোনো প্রকার গোপন সন্ধি করতে পারবে না; কিংবা মদিনাবাসীর বিরুদ্ধে কুরাইশদের সাহায্য করতে পারবে না।
৯. চুক্তিপত্রের পক্ষগুলোর বিরুদ্ধে কেউ লড়াই করলে পক্ষগুলো পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে তা প্রতিহত করবে এবং পক্ষগুলো নিজেদের মধ্যে পরামর্শ ও কল্যাণকামিতা বজায় রাখবে।
১০. চুক্তির পক্ষগুলোর জন্য ইয়াসরিব একটি সংরক্ষিত ও পবিত্র নগরী হিসেবে বিবেচিত হবে।
১১. ইয়াসরিবকে কেউ আক্রমণ করলে চুক্তির সকল পক্ষ পারস্পরিক সাহায্যের মাধ্যমে তা প্রতিহত করবে।
১২. প্রতিবেশীকে নিজের মতোই গণ্য করতে হবে। তার কোনো ক্ষতি বা তার প্রতি কোনো অপরাধ করা যাবে না।
১৩. কোনো বিষয়ে যখনই মতানৈক্য হবে, তখন তা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের কাছে ন্যস্ত করতে হবে।
১৪. অঙ্গীকার রক্ষা করতে হবে, ভঙ্গ করা যাবে না।
মদিনা সনদের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
মদিনা সনদ মহানবি (সা.) -এর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় বহন করে। এই সনদে সকলের ধর্মীয় স্বাধীনতার স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। এর মাধ্যমে মদিনাবাসী একটি ঐক্যবদ্ধ জাতিতে পরিণত হয় এবং ইসলামি প্রজাতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপিত হয়। মহানবি (সা.) মদিনা পুনর্গঠনের সুযোগ পান। ফলশ্রুতিতে তাঁর ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়।
এই সনদ মদিনার সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও নাগরিক জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসে। এর ফলে শতধাবিভক্ত আরবদের মধ্যে ঐক্য স্থাপিত হয়। অনেক আগে থেকে চলে আসা গৃহযুদ্ধ ও অনৈক্যের পরিবর্তে ইয়াসরিবে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে আসে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রত্যেকের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। মুসলিম অমুসলিমদের মধ্যে সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে ওঠে। সকলের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত হয়। সর্বোপরি এই সনদের মাধ্যমে ইসলামের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। বিশ্ববাসীর নিকট ইসলামের সম্প্রীতি, ভ্রাতৃত্ব, পরমতসহিষ্ণুতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের আদর্শ ছড়িয়ে পড়ে।
ইসলামের বিধানসমূহ প্রবর্তন
মহানবি (সা.)-এর মদিনা জীবনের শুরুটা ছিল ইসলামের বিধান প্রবর্তনের সময়। মদিনা জীবনের শুরুতেই ৬২২ খ্রিস্টাব্দে আজানের রীতি প্রবর্তিত হয়। ৬২৩ খ্রিস্টাব্দে মহান আল্লাহ বায়তুল মুকাদ্দাস -এর পরিবর্তে বায়তুল্লাহকে কেবলা নির্ধারণ করেন। একই বছরে মুসলমানদের জন্য রমযানের এক মাস সাওম পালনের বিধান প্রবর্তিত হয়। এ বছরেই মুসলমানদের প্রধান দু'টি ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা উদযাপন শুরু হয়। এছাড়াও এই বছরে ইসলামের তৃতীয় স্তম্ভ যাকাতের বিধান নাযিল হয়।
বদর যুদ্ধের পটভূমি
মদিনায় হিজরতের পর রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সম্মান, মর্যাদা ও শক্তি আরো বৃদ্ধি পায়। মদিনার ধর্মীয় সহাবস্থান ও সামাজিক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠিত হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নেতৃত্বে মদিনার উন্নতি দেখে মক্কার কুরাইশরা ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়ে। ফলে তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে শত্রুতা এবং মদিনার আশেপাশে লুটতরাজ শুরু করে। এসময় মদিনার মুনাফিক আব্দুল্লাহ ইবন উবাই-এর নেতৃত্বে একদল ইহুদি কুরাইশদের সাথে গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। তারা মহানবি (সা.) ও মুসলমানদেরকে ধ্বংস করার পরিকল্পনায় লিপ্ত থাকে। এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে সিরিয়ার সাথে কুরাইশদের বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল। রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় হিজরত করায় তারা মদিনাকে তাদের বাণিজ্য পথের হুমকি মনে করে। এ হুমকি দূর করতে তারা একটি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে।
মহানবি (সা.) কুরাইশদের এসকল অপতৎপরতার গতিবিধি লক্ষ রাখার জন্য আব্দুল্লাহ ইবনে জাহাশের নেতৃত্বে মক্কার উপকন্ঠে একটি দল প্রেরণ করেন। তখন ছিল রজব মাস। রজব মাসে যুদ্ধ করা নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু নাখলা নামক স্থানে কুরাইশদের একটি দলের সাথে জাহাশের নেতৃত্বাধীন দলের যন্ডযুদ্ধ সংঘঠিত হয় এতে কুরাইশদের দলনেতা আমর বিন হাযরামী নিহত হয়। নিষিদ্ধ মাসে যুদ্ধ করায় মহানবি (সা.) আব্দুল্লাহ ইবনে জাহাশকে ভর্ৎসনা করেন। নাখলার এ ঘটনায় কুরাইশদের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। তারা প্রতিশোধের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। অবশেষে মদিনার মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য তারা চূড়ান্ত রণপ্রস্তুতি গ্রহণ করে।
এদিকে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, সিরিয়া থেকে ফেরার পথে আবু সুফিয়ানের বাণিজ্যিক কাফেলা মুসলমানদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। গুজবের সত্যতা যাচাই না করেই কুরাইশরা আবু জেহেলের নেতৃত্বে ১০০০ (এক হাজার) সুসজ্জিত সৈন্য নিয়ে যুদ্ধের জন্য বের হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাদের এ সংবাদ জানতে পেরে চিন্তিত হয়ে পড়েন। তখন মহান আল্লাহ ওহি পাঠিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে সান্ত্বনা প্রদান করেন এবং যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণের পরামর্শ দেন।
যুদ্ধের ঘটনা
মহানবি (সা.) মদিনার অদূরে বদর প্রান্তরে মুসলিম সৈন্য নিয়ে হাজির হন। তাঁর সঙ্গী হলেন ২৫৩ জন আনসার এবং ৬০জন মুহাজিরসহ মোট ৩১৩ জন সৈন্যের একটি দল। অপরপক্ষে মক্কার কাফিরদের ছিল ১০০০ (এক হাজার) সৈন্যের সুসজ্জিত দল। এর মধ্যে তিনশত অশ্বারোহী এবং সাতশত উদ্ভারোহী। মহানবি (সা.) যুদ্ধের শুরুতে সৈন্যদের উদ্দেশ্যে উপদেশ ও নির্দেশনামূলক ভাষণ প্রদান করেন। দ্বিতীয় হিজরি ১৭ রমযান মোতাবেক ১৭ মার্চ ৬২৪ খ্রিস্টাব্দে বদর প্রান্তরে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ১০০০ জন সুসজ্জিত সৈন্যের বিরুদ্ধে মাত্র ৩১৩ জন ইমানি শক্তিতে বলিয়ান সৈনা অসম যুদ্ধে অবতীর্ণ হন।
প্রথমেই সম্মুখ যুদ্ধে কুরাইশদের নেতা উতবা, শায়বা ও ওয়ালিদ পরাজিত ও নিহত হয়। এরপর যুদ্ধের অল্পক্ষণের মধ্যেই মহান আল্লাহর সাহায্যে মুসলিম সৈন্যরা কুরাইশদের ওপর বিজয়ী হলেন। ৬ জন মুহাজির ও ৮জন আনসারসহ মোট ১৪ জন মুসলমান শাহাদাত বরণ করেন। অপরপক্ষে ৭০ জন কাফির-মুশরিক নিহত হয় এবং সমসংখ্যক সৈন্য যুদ্ধবন্দী হয়।
যুদ্ধবন্দীদের সাথে সহানুভবতা
রাসুলুল্লাহ (সা.) বদরের যুদ্ধবন্দীদের সাথে সহানুভূতির মনোভাব পোষণের নির্দেশ দেন। ফলে মুসলিম সৈন্যরা যুদ্ধবন্দীদের সাথে উদার ও মানবিক আচরণ করেন। তাদের মধ্যকার বস্ত্রহীনদের বস্তু প্রদান করা হয়। তাঁদের খাদ্য প্রদান করা হয়। সবশেষে মুক্তিপণ নিয়ে আটক কুরাইশ সৈন্যদের মুক্ত করে দেওয়া হয়। কয়েকজন যুদ্ধবন্দীকে মুসলিম বালকদের শিক্ষাদানের বিনিময়ে মুক্ত করে দেওয়া হয়। এমনকি ভবিষ্যতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করবে না এ মর্মে ওয়াদা প্রদানের মাধ্যমেও অনেককে মুক্তি দেওয়া হয়। যুদ্ধবন্দীদের প্রতি এমন মহানুভবতা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল।
যুদ্ধের গুরুত্ব
বদরযুদ্ধে মুসলমানদের জয়লাভের মাধ্যমে বিশ্বের ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। এটি ছিল সত্য ও মিথ্যার মধ্যে ফয়সালাকারী যুদ্ধ। এ যুদ্ধে জয়লাভের ফলে মিথ্যার উপর সত্যের বিজয় হয়। মক্কার কাফির- মুশরিকদের দন্ত চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়। মদিনা ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ইসলামের অবস্থান সুদৃঢ় হয়। তাছাড়া এত অল্পসংখ্যক মুসলিম সৈন্য বিপুলসংখ্যক অমুসলিম সৈন্যের বিপরীতে জয়ী হওয়ার ফলে তাঁদের মনোবল ও ইমানি শক্তি বৃদ্ধি পায়। চূড়ান্তভাবে কুরাইশদের ক্ষমতা ও শক্তি খর্ব হয় এবং মহানবি (সা.)-এর শক্তি ও মর্যাদা আরো বৃদ্ধি পায়। ফলে দলে দলে লোক ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে।
এছাড়া কুরাইশদের ফেলে যাওয়া অস্ত্র-শস্ত্র, ঘোড়া, উট এবং অন্যসামগ্রী লাভের মাধ্যমে মুসলমানদের পার্থিব শক্তি-সামর্থ্য বৃদ্ধি পায়। মদিনা ও আশেপাশের ষড়যন্ত্রকারী মুনাফিক ও ইহুদিদের উপর মুসলমানরা প্রভাব বিস্তার করে। সর্বোপরি আরবের বুকে ইসলাম এক অপরাজেয় শক্তি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
উহুদের যুদ্ধের পটভূমি
বদরের যুদ্ধে পরাজয়ের গ্লানি মক্কার কুরাইশরা ভুলতে পারেনি। তারা বদরের প্রতিশোধ নিতে উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল। এ সময় মক্কার কবিরা তাদের কবিতায় মদিনার বিরুদ্ধে উত্তেজনা ছড়াতে থাকে। কুরাইশ নারীরা তাদের পুরুষদেরকে আরো একটি যুদ্ধের উন্মাদনা সৃষ্টি করতে থাকে। ফলে কুরাইশরা বদর যুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য আরেকটি যুদ্ধের সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করে।
যুদ্ধের ঘটনা
তৃতীয় হিজরি সালে মক্কার কাফির-মুশরিকরা উমাইয়া নেতা আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে ৩০০০ (তিন হাজার) সৈন্য নিয়ে মদিনা অভিমুখে রওয়ানা হয়। তারা মদিনার নিকটবর্তী উহুদ পাহাড়ের পাদদেশে শিবির স্থাপন করে। কুরাইশদের মদিনা অভিযানের সংবাদ পেয়ে মহানবি (সা.) ১০০০ (এক হাজার) সৈন্যর একটি দল প্রস্তুত করেন। পথিমধ্যে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই বিশ্বাসঘাতকতা করে ৩০০ সৈন্যসহ সরে দাঁড়ায়। ফলে মহানবি (সা.) মাত্র ৭০০জন সৈন্য নিয়ে কুরাইশদের বিশাল বাহিনীর মুখোমুখি হন। ২৩ মার্চ ৬২৫ খ্রিস্টাব্দে উভয় দল সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। যুদ্ধের শুরুতে মুসলিম সৈন্যদের আক্রমণে কুরাইশরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এ সময় গিরিপথে পাহারারত মুসলিম সৈন্যদল এটিকে চূড়ান্ত বিজয় মনে করে গনিমতের মাল কুড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এ সুযোগে কুরাইশদের অশ্বারোহী দল পেছন থেকে আক্রমণ করে মুসলিম সৈন্যদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
যুদ্ধের ফলাফল
উহুদ যুদ্ধে ৭০জন মুসলিম বীর শাহাদাত বরণ করেন। আর মাত্র ২৩ জন কাফির মৃত্যুবরণ করে। নেতার আদেশ অমান্য করা এবং শৃঙ্খলাবোধের অভাবে এ যুদ্ধে মুসলমানদের বিপর্যয় হয়। এছাড়া তৎকালীন মুশরিক নেতা খালিদ বিন ওয়ালিদের রণকৌশল মুসলমানদের বিপর্যয়ে ভূমিকা রেখেছিল।
যুদ্ধের গুরুত্ব
এ যুদ্ধ ছিল মুসলমানদের ধৈর্য ও ইমানের অগ্নিপরীক্ষা। সাময়িক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে মুসলমানগণ ধৈর্য ও ইমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। সাময়িকভাবে বিজয়ী হয়েও কুরাইশরা মুসলমানদের পশ্চাদ্ধাবন করতে সাহস করেনি। কোনো মুসলিমকে বন্দিও করতে পারেনি। অপরদিকে মহানবি (সা.) মুসলিম সৈন্যদের একটি দলকে কাফিরদের পশ্চাদ্ভাবনে প্রেরণ করেন। এতে মুসলমানদের সাহস ও মনোবল আরো বৃদ্ধি পায়। তাঁদের সাময়িক বিপর্যয় ভবিষ্যৎ বিজয়ের পথকে উন্মোচিত করে। নেতার আদেশ অমান্য করার ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে তাঁরা সম্যকভাবে অবহিত হন। পরবর্তীকালে আর কোনো যুদ্ধে তাঁরা এ ভুল করেননি।
খন্দকের যুদ্ধের পটভূমি
মক্কার কুরাইশরা উহুদের যুদ্ধে সাময়িকভাবে জয়লাভ করলেও যেসব উদ্দেশে তারা যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল, সেসবের কোনোটাই অর্জিত হয়নি। তারা মদিনায় রাসুল (সা.) এর শক্তি, সম্মান ও মর্যাদা দুর্বল করতে পারেনি। সিরিয়ার সাথে তাদের বাণিজ্য পথও নিরাপদ হয়নি। তাছাড়া কুরাইশরা ফিরে যাওয়ার পরে মদিনার মুসলমানরা আরো বেশি শক্তিশালী ও সুসংগঠিত হয়ে ওঠে। তাই কুরাইশরা তাদের ধর্মীয়, সামাজিক এবং বাণিজ্যিক সুবিধা বৃদ্ধির জন্য আরেকটি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। এ সময় মদিনা শহরতলিতে বসবাসরত বেদুঈনরা তাদের লুটতরাজ বজায় রাখার জন্য কুরাইশদের সাথে আঁতাত শুরু করে দেয়। তাছাড়া উহুদ যুদ্ধের পর বনু নাখির গোত্রকে বিশ্বাসঘাতকতা ও অন্তর্যাতমূলক কার্যকলাপের জন্য মদিনা থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে স্থানীয় ও পার্শ্ববর্তী লোকদের উসকানি দিতে থাকে। যার ফলে আরেকটি যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে।
যুদ্ধের প্রস্তুতি
৬২৭ খ্রিস্টাব্দে মক্কার কুরাইশ, মদিনার পার্শ্ববর্তী বেদুঈন এবং মদিনা থেকে বিতাড়িত ইহুদি এই তিনশক্তি একত্রিত হয়। তারা আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে ১০,০০০ (দশ হাজার) সৈন্যের একটি বিরাট বাহিনী গঠন করে। এই ত্রিশক্তির ঐক্যবদ্ধ আক্রমণ মোকাবেলা করার জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) ৩,০০০ (তিন হাজার) সৈন্য সংগ্রহ করেন। তিনি শত্রু মোকাবেলার জন্য সাহাবাদের নিয়ে পরামর্শ সভা আহ্বান করেন। সালমান ফার্সির পরামর্শক্রমে পরিখা খননের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মদিনার দক্ষিন দিক ঘন খেজুর বাগান দ্বারা সুরক্ষিত ছিল আর পূর্বদিকে বনু কুরাইযার সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক ছিল। তাই মদিনার উত্তর ও পশ্চিম দিক অরক্ষিত ও উন্মুক্ত থাকায় এ দু'দিকে পরিখা খনন করা হয়। প্রায় ৩০০০ মুহাজির ও আনসার কঠোর পরিশ্রম করে এক সপ্তাহে খনন কাজ সমাপ্ত করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজেও খনন কাজে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
খন্দক বা পরিখা খননের মাধ্যমে কাফিরদের মোকাবেলা করা হয়েছিল বলে এ যুদ্ধকে পরিখা বা খন্দকের যুদ্ধ বলা হয়। এছাড়া কাফির-মুশরিকদের বিভিন্ন দল একত্রিত হয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল বলে এ যুদ্ধ আহযাবের (আহযাব অর্থ দল বা সম্প্রদায়সমূহ) যুদ্ধ নামেও পরিচিত।
যুদ্ধের ঘটনা
কুরাইশদের সৈন্যবাহিনী মদিনার উপকন্ঠে তাঁবু স্থাপন করে। তারা মদিনা শহর রক্ষায় মহানবি (সা.) -এর অভিনব কৌশল দেখে বিস্মিত হল্যে। ৩১ মার্চ ৬২৭ খ্রিস্টাব্দে যুদ্ধ শুরু হলো। আবু সুফিয়ান ২৭ দিন মদিনা অবেরোধ করে রাখেন। এ সময় কুরাইশবাহিনী পরিখা অতিক্রম করে হামলা চালাতে বারবার ব্যর্থ হয়। আস্তে আস্তে তাদের খাদ্য ও রসদের অভাব দেখা দেয়। প্রবল ঝড়-কঞ্জা ও বাতাসে তাদের তাঁবুগুলো উড়ে যায়। ফলে আবু সুফিয়ান অবরোধ ত্যাগ করে মক্কার ফিরে যেতে বাধ্য হয়।
যুদ্ধের ফলাফল
মহানবি (সা.) -এর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, উন্নত রণকৌশল এবং গোয়েন্দাদের সফলতার কারণে মুসলমানরা এ যুদ্ধে জয়লাভ করে। অপরদিকে কাফির-মুশরিক ও ইহুদিদের সম্মিলিত বাহিনী পরাজিত হয়। মুসলমানদের ঐক্য, শৃঙ্খলা এবং দৃঢ় মনোবলের পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং খাদ্য-রসদের সংকট কাফিরদের পরাজয়ের অন্যতম কারণ।
এ যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে কাফিরদের দন্ত শেষ হয়ে যায়। তাদের সামরিক শক্তির দুর্বলতা প্রকাশ পায় এবং তাদের সম্পদ নিঃশেষ হয়ে যায়। অপরদিকে মহানবি (সা.)-এর প্রভাব-প্রতিপত্তি বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। মুসলমানদের ধর্ম ও বাণিজ্য প্রসারের সমস্ত বাধা দূর হয়। মদিনার পার্শ্ববর্তী ইহুদি ও বেদুঈন গোত্রের উপর মুসলমানরা প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। ফলে তারা স্বেচ্ছায় মুসলমানদের মিত্রে পরিণত হয়।
বনু কোরায়যা গোত্রের ইহুদিরা চুক্তি ভঙ্গ করে বিশ্বাসঘাতকতা করায় তাদের যথাযথ শাস্তি দেওয়া হয়।
হুদায়বিয়ার সন্ধির প্রেক্ষাপট
মদিনায় হিজরতের পর দীর্ঘ ৬ বছর মুসলমানরা পবিত্র হজ পালন করতে পারেননি। প্রিয় জন্মভূমির দর্শনও লাভ করেননি। তাই খন্দক যুদ্ধে জয়লাভের পর মুহাজিরদের মন স্বদেশে যাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। মহানবি (সা.) তাদের অন্তরের ব্যথা বুঝতে পারেন। তাই তিনি ৬২৮ খ্রিস্টাব্দের জিলকদ মাসে মাতৃভূমির দর্শন ও পবিত্র ওমরাহ পালনের জন্য ১৪০০ জন সাহাবিসহ মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।
যিলকদ মাসে যুদ্ধবিগ্রহ নিষিদ্ধ ছিল। তাই মহানবি (সা.) আশা করেছিলেন, এ মাসে বিধর্মীরা তাদেরকে বাঁধা দিবে না। তিনি সাহাবিদের নিয়ে মক্কার নিকটবর্তী হুদায়বিয়া নামক স্থানে তাঁবু স্থাপন করেন। কিন্তু মক্কার কুরাইশরা খালিদ ও ইকরামার নেতৃত্বে একটি দল পাঠিয়ে মুসলমানদের বাঁধা প্রদান করে। মহানবি (সা.) বুদাইল নামক ব্যক্তির মাধ্যমে কুরাইশদের জানালেন যে, তিনি শুধুমাত্র ওমরাহ পালন করে চলে যাবেন; এছাড়া আর কোনো উদ্দেশ্য নেই। কিন্তু কুরাইশরা তাঁর কথায় কর্ণপাত করলো না। মহানবি (সা.) আলোচনার জন্য উসমান (রা.)-কে তাদের কাছে পাঠালেন। কিন্তু তারা আলোচনা না করে উসমান (রা.)-কে আটক করে। এদিকে হযরত উসমান (রা.) ফিরে আসতে দেরি হওয়ায় মুসলমানদের মাঝে গুজব রটে যে, কুরাইশরা তাঁকে হত্যা করেছে। তাই মুসলমানরা উসমান (রা.) এর হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাতে আমরণ সংগ্রামের বাইয়াত (শপথ) গ্রহণ করেন। এটিই ইতিহাসে বাইয়াতুর রেদওয়ান নামে পরিচিত। আল্লাহ এ সন্ধির ফলে মহানবি (সা.) রাজনৈতিক ও ধর্মীয় স্বীকৃতি লাভ করেন। শান্তির দূত হিসেবে তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা প্রমাণিত হয়। কুরাইশরা আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁকে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতা হিসেবে মেনে নেয়। এ সন্ধিতে ১০ বছর যুদ্ধ বন্ধ থাকার কথা ঘোষনা করা হয়, ফলে নিজ গোত্র কুরাইশদের সাথে মহানবি (সা.) -এর দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে। মহানবি (সা.) আপাতত কুরাইশদের শত্রুতা থেকে নিস্তার পেয়ে নির্বিঘ্নে ইসলাম প্রচারে মনোনিবেশ করেন। এসময় তিনি রোম সম্রাট, পারস্য-সম্রাট, আবিসিনিয়ার নাজ্জাশি প্রমুখের কাছে দূত পাঠিয়ে ইসলামের দাওয়াত প্রদান করেন। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে অনেকেই ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়।
মোটকথা, হুদায়বিয়ার সন্ধি ইসলামের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচনকারী হিসেবে আবির্ভূত হয়।
প্যানেল আলোচনা |